২০২৪: স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির বছর
২০২৪ সাল ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর, যা একদিকে স্বৈরশাসন ও জুলুমের অবসান, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বছরের শুরুতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে পৌঁছায়, যেখানে আন্দোলনকারীরা দাবি জানায় সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। আন্দোলন দমন করতে সরকার গুলি চালায়, যার ফলে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার মৃত্যু হয়।
এ বছরের ২২ জুলাই, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠকে শেখ হাসিনা দাবি করেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায়নি, পালায় না’। কিন্তু ১৩ দিন পরই তিনি ভারতে পালিয়ে যান, আর এভাবে শেষ হয় দীর্ঘ দুই দশকের শাসন। এরপর, ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, যা ছিল সম্পূর্ণভাবে বিতর্কিত। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতোই এটি ছিল পাতানো নির্বাচন, তবে এবার সরকারের নিজ দলের ‘ডামি’ প্রার্থীদের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করা হয়। নির্বাচন বাতিল হওয়া সত্ত্বেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার শুরু হয়।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও ২০২৪ ছিল সংকটপূর্ণ বছর। দেশে মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের কারণে জনগণের জীবনযাত্রা চরম কষ্টের মধ্যে পড়েছিল। সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যায়, যা দেশের আর্থিক পরিস্থিতিকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে।
একদিকে যেখানে সরকারের শাসন অস্থিতিশীল, সেখানে ছাত্র আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের জুন মাসে হাইকোর্ট সরকারি চাকরিতে কোটা পুনরুদ্ধার ঘোষণা করলে, ছাত্ররা আন্দোলনে নেমে আসে। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার বিতর্কিত মন্তব্য ছাত্র-জনতার ক্ষোভের আগুনে তেল ঢালে। শেখ হাসিনা দাবি করেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবেন? এই বক্তব্যের পরপরই আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর হামলা শুরু হয়। ছাত্রলীগ সহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করে, পুলিশ গুলি চালায়, এবং আন্দোলনকারীদের মেরে ফেলা হয়।
১৫ জুলাইয়ের পর আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে, এবং ১৯ জুলাই সরকার কারফিউ জারি করে। পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মীরা মিলিতভাবে আন্দোলন দমন করতে শুরু করে, কিন্তু আন্দোলনকারীরা থেমে না গিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়।
পরিস্থিতি যখন চরমে পৌঁছায়, তখন ৫ আগস্ট ঢাকা অভিমুখী বিশাল জনগণনির্ভর মিছিল একত্রিত হয়। সেই সময়, শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছাড়েন। এর পরপরই, গণভবন ও সংসদ ভবনে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। শেখ হাসিনার পতনের পর, আওয়ামী লীগ নেতারা পালিয়ে যান, এবং পুলিশের সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান।
এদিকে, গোপন বন্দিশালাগুলোতে গুমের শিকার মানুষের তথ্য সামনে আসে। গুম-প্রক্রিয়া পরিচালনায় শেখ হাসিনার সরাসরি সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্তে উঠে আসে। এছাড়া, নতুন সরকারের অধীনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০২৪ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়।
অন্যদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এখন রাজনৈতিক দলের গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এবং তারা জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করে বিভিন্ন থানায় সংগঠন পরিচালনা করছে। দেশজুড়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ছাত্ররা এক নতুন যুগের সূচনা করছে।
২০২৪ সালের শেষের দিকে, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল শেখ হাসিনার পতন, স্বৈরাচারের অবসান, এবং গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা। দেশটি এখন নতুন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যেখানে গঠনমূলক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে।
এ বছর, বাংলাদেশের জনগণ তাদের সংগ্রাম ও সাহসিকতার মাধ্যমে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে, যা দেশের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
1 Comments
ছাত্র জনতার এতো রক্ত যেন বৃথা না যায় এটাই আমাদের কাম্য।
ReplyDelete