ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নিয়ে 'পানিযুদ্ধে' জড়াচ্ছে চীন-ভারত!



ভারত সরকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং নদীর উপর একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। তবে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তাদের দাবি, এই বাঁধ নির্মিত হলে ২০টি গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে এবং আরও দুই ডজন গ্রাম ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই তারা কোনোভাবেই বাঁধ নির্মাণ হতে দিতে চায় না।

তবে ভারত সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্রস্তুত এবং এতে ১৩.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। বাঁধ নির্মিত হলে একটি জলাধার তৈরি হবে, যা ৯ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণ করতে পারবে এবং এর মাধ্যমে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, এটি ভারতের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হয়ে উঠবে।

২০১৭ সালে এই প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয়েছিল, এবং এখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এর সম্ভাব্যতা যাচাই করছেন। তবে স্থানীয়রা এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার বিক্ষোভ দমনের জন্য আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে, তবে এখনও কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, সরকার তাদের বাড়িঘর ও নদী-নালা দখল করে শিল্পাঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা করছে, যা তারা মেনে নিতে পারে না। সিয়াং আদিবাসী কৃষক ফোরামের সভাপতি জিজং জানিয়েছেন, "যতদিন বেঁচে আছি, এই বাঁধ নির্মাণ হতে দেব না।"

অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাঁধ নির্মাণ নয়, বরং সিয়াং নদীকে বাঁচানো।

চীন ও ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা

এই বাঁধ প্রকল্পের সাথে জড়িত রয়েছে নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের বিশেষ স্বার্থ। চীন ও ভারত পানি এবং নিরাপত্তার জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে একটি ভূ-কৌশলগত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, যার ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সীমান্ত সংঘর্ষও ঘটেছে।

সিয়াং নদী তিব্বতের কৈলাস পর্বত থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ভারতের অরুণাচল প্রদেশে প্রবাহিত হওয়ার পর, এটি ব্রহ্মপুত্র নদ হিসেবে পরিচিত। এরপর এটি বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলিত হয়। গত মাসে, চীন তিব্বতের মেদোগ কাউন্টিতে ইয়ারলুং জাংবো নদীর উপর বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে।

২০২০ সালে চীন এই বাঁধ প্রকল্পের পরিকল্পনা প্রথম ঘোষণা করে এবং এরপর ভারতের কর্মকর্তারা চীনা প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব প্রশমিত করার জন্য পাল্টা বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভাবতে শুরু করে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, হিমালয় অঞ্চলে বিশাল এই বাঁধ দুটি স্থানীয় লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি

এই বাঁধ নির্মাণের কারণে স্থানীয়দের জীবনযাত্রায় বিপর্যয় আসতে পারে, বিশেষ করে এই অঞ্চলের ভূমিকম্প প্রবণতা এবং ঘন ঘন বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনায়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতের বাঁধ এবং চীনের বাঁধের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর জন্য অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করতে পারে।

চীনের মেদোগ বাঁধের নির্মাণও অনেক বড় বিপদ তৈরি করবে। চীন এর মাধ্যমে প্রতিবছর প্রায় ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। তবে এই বিশাল জলাধারের ফলে, ভারতে এবং বাংলাদেশের মতো নিম্ন নদীতীরবর্তী অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের প্রতি প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, ভারত ও চীনের মধ্যে এই জলবায়ু সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে বিপদগ্রস্ত করতে পারে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বেশিরভাগ পানি বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়, এবং এর উপর বাঁধ নির্মাণ বাংলাদেশে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।

রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন জানিয়েছেন, "যদি এই বাঁধগুলোর প্রভাব বেড়ে যায়, তবে এটি বাংলাদেশের নদী তীরবর্তী এলাকার ভাঙন বাড়িয়ে দিতে পারে।"

বিশ্লেষকরা বলেন, এই পরিস্থিতিতে ভারত ও বাংলাদেশকে জলসম্পদ নিয়ে যৌথভাবে আলোচনায় বসতে হবে, কারণ এককভাবে কোনো দেশই এই পানি সংকট মোকাবিলা করতে পারবে না।

এদিকে, এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভারত ও চীন পরস্পরের মধ্যে বিরোধ ছড়িয়ে ফেলছে, এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জলবায়ু সংকট আরো তীব্র হতে চলেছে।